দেশের মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটলে হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্টরা মামলা দিতে পারেন। তবে এসব মামলার তদন্ত তারা করতে পারেন না। তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। এতে দুর্ঘটনাগুলোর সঠিক প্রতিকার হচ্ছে না এবং দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমছে না বলে মনে করছে হাইওয়ে পুলিশ। তাই সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্টদের তদন্ত ক্ষমতা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলার তদন্ত একটি বিশেষায়িত তদন্ত। এ বিষয়ে কারিগরী জ্ঞান পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টরদের চেয়ে সড়কে দায়িত্ব পালনকারী সার্জেন্টদের বেশি। যানবাহনের বিষয়ে সার্জেন্টদের প্রায়োগিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ রয়েছে। ট্রাফিক বিধি-বিধান বিষয়ক দক্ষতায়ও সার্জেন্টরা বেশি পারদর্শী। তাই এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত সার্জেন্টরা করলে বেশি ফলপ্রসূ হবে।বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, শুধু জরিমানা করার ক্ষমতা নয় বরং সড়কে দুর্ঘটনা ও বড় অপরাধগুলোর মামলার তদন্ত ক্ষমতা সার্জেন্টদের দেওয়া উচিত। যেহেতু সাব ইন্সপেক্টর ও সার্জেন্টরা একই পদমর্যাদার সেহেতু তাদের উভয়ের তদন্তের ক্ষমতা থাকা উচিত। এতে তদন্তের গুণগত মান বাড়বে।
যা বলা হয়েছে হাইওয়ে পুলিশের প্রস্তাবে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হাইওয়ে পুলিশের প্রস্তাবের একটি কপি ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে- হাইওয়ে পুলিশের বর্তমান অধিক্ষেত্র প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার। তার মধ্যে ২৯৯১.৫০ কিলোমিটার মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম চালু রয়েছে। হাইওয়ে পুলিশে বর্তমানে এসআই (নিরস্ত্র) পদে ১৭৮ জন এবং সার্জেন্ট পদে ১২৮ জন কর্মরত আছে। সড়ক দুর্ঘটনা ও ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন সংক্রান্ত সকল মামলা শুধুমাত্র সাব-ইন্সপেক্টরগণ তদন্ত করে থাকেন। পক্ষান্তরে সার্জেন্টিগণ টাউন ট্রাফিক ব্রাঞ্চে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বিশেষায়িত ট্রেনিং নিয়ে থাকেন। সে জন্য সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত কারিগরী জ্ঞান সাব-ইন্সপেক্টরদের চেয়ে সার্জেন্টদের বেশি।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে— সড়ক দুর্ঘটনা মামলার তদন্ত একটি বিশেষায়িত তদন্ত। যানবাহন সংক্রান্তে সার্জেন্টদের প্রায়োগিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ রয়েছে। যানবাহনের কারিগরী গঠন ও বিন্যাস এবং ট্রাফিক বিধি-বিধান সংক্রান্ত দক্ষতায় সার্জেন্টরা অধিকতর পারদর্শী। সার্জেন্টগণ সড়ক ও মহাসড়ক কেন্দ্রিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সেজন্য তাদেরকে তদন্ত ক্ষমতা দিলে একদিকে মামলা তদন্তের গুণগত মান বাড়বে, অন্যদিকে পুঞ্জিভূত সড়ক দুর্ঘটনার মামলাও তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হবে।
রাস্তাতেই সীমাবদ্ধ ক্ষমতা
মামলা তদন্তের দায়িত্ব একটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাইওয়ে পুলিশের এক সার্জেন্ট ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সরাসরি ঘটনাস্থলে থাকি। একটি খুন বা একটি ছিনতাই কীভাবে হলো বা কারা এখানে যুক্ত আছে এটা কিন্তু আমরা সরাসরি দেখি বা এ বিষয় বেশি তথ্য আমাদের কাছে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এসব ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী হবার পরেও মামলা তদন্তের দায়িত্ব আমরা পাই না। আমাদের কাছে বেশি তথ্য থাকলেও সেটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায় না। আমাদের ক্ষমতা তো রাস্তাতেই সীমাবদ্ধ।
তিনি বলেন, সড়কে নানা ঘটনায় অনেক মামলা হয় কিন্তু বিচার হয় না। মামলার পর আসলে হাইওয়ে পুলিশের আর কিছু করার থাকে না। মামলার পর ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং ভুয়া ও অদক্ষ চালকদের সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এরপর কেউ তদবিরে, কেউ কিছুদিন সাজা খেটে আবার মহাসড়কে নেমে পড়েন। আর এ কারণে কমানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাইওয়ে পুলিশের একজন অফিসার ইনচার্জ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সার্জেন্টরা মামলার তদন্ত করতে পারে না, তবে তারা প্রোসিকিউশন মামলা দিতে পারে। জরিমানার মামলাগুলো করতে পারে কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার সকল মামলাই সাব ইন্সপেক্টররা (নিরস্ত্র) তদন্ত করেন। একটি ফৌজদারি মামলা তদন্ত করতে হলে সিজার লিস্ট করা প্রয়োজন, সাক্ষী গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়, ঘটনাস্থলের সূচিপত্র অঙ্কন করতে হয়, চার্জশিট লিখতে হয়; এগুলো তো সার্জেন্টরা পারেন না। এটার জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়। যদি সার্জেন্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় তাহলে এসব মামলা তারা তদন্ত করতে পারবেন।
যা বললেন হাইওয়ে পুলিশ প্রধান
হাইওয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল আইজি মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সার্জেন্টদের একটু প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া তারা এটা পারবেন না। আমরা এটা নিয়ে চেষ্টা করছি, তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সার্জেন্টরা মামলা তদন্তের ক্ষমতা পেলে ঘটনার সঠিক চিত্র উঠে আসবে, এটা সত্য।
তিনি বলেন, আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন। আমাদের রেকারে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। এম্বুলেন্স চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আমরা এসবের চাহিদা দিয়েছি। তবে এগুলো পেতে একটু সময় লাগবে। শুধু তাই নয়, আমার জনবল প্রয়োজন ১০ হাজার, সেখানে আছে তিন হাজার। ফলে আমরা জনবল বৃদ্ধির জন্যও বলেছি। ওইটা ভেটিং পর্যায়ে আছে। পর্যাপ্ত জনবল হলে হাইওয়ে হবে আরও নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল।
মন্ত্রণালয় কী ভাবছে?
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি প্রস্তাব এসেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাদের (হাইওয়ে পুলিশ) মামলা তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হবে কি না সেটা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে ফাইল উঠলে তখন বলা যাবে।
অপরাধ বিশ্লেষকের মত
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমার মনে হয় তাদের দাবি যৌক্তিক এবং শিগগির বাস্তবায়ন করা উচিত। কেননা যিনি ঘটনাস্থলে থাকেন, তথ্য-উপাত্তের সমন্বয়ে মামলা দাখিল করেন তার কাছেই তদন্তভার ন্যস্ত করা উচিত। এ বিশ্লেষক বলেন, অন্যের উপর দায় চাপানোর সংস্কৃতি রয়েছে আমাদের, সেটি পুলিশের ক্ষেত্রেও রয়েছে। সার্জেন্টের রুজুকৃত মামলায় যখন নতুন করে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়, সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা অনেক সময় মামলা সম্পর্কে সঠিকভাবে বুঝে ওঠার আগেই অন্যত্র বদলির অর্ডার চলে আসে। আবার দেখা যায় আলামত নষ্ট হয়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে মামলাগুলোকে ভিন্ন দিকে মোড় দেওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাই সার্জেন্টদের রুজুকৃত মামলার তদন্তভার তাদের ওপরই ন্যস্ত করা হলে সেটাই ভালো সিদ্ধান্ত হবে।
Leave a Reply