আন্তর্জাতিক ডেস্ক: শান্তি আলোচনার মধ্যে ইউক্রেনে সবচেয়ে ভয়াবহ ড্রোন হামলা চালাল রাশিয়া। এক রাতে ৪৬০ টি ড্রোন ও ১৯ মিসাইল হামলা চালিয়েছে রাশিয়া, যা গত তিন বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে বড় হামলা বলে দাবি করেছে ইউক্রেনের বিমানবাহিনী।
সোমবার (৯ জুন) ইউক্রেন বিমানবাহিনীর বরাত দিয়ে আল জাজিরা দাবি করেছে, বিমানবাহিনী দাবি করেছে গতরাতে রাশিয়া ৪৬০ টি ড্রোন ও ১৯ মিসাইল হামলা চালিয়েছে। এটাই সবচেয়ে বড় হামলা। ইউক্রেনের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে হামলা চালানো হয়।
ইউক্রেনের বিমানবাহিনী দাবি করেছে, তারা ২৭৭টি ড্রোন এবং ১৯টি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে। মাত্র ১০টি ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
এই হামলায় একজন আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে, যদিও স্বাধীনভাবে এই তথ্য যাচাই সম্ভব হয়নি।
যুদ্ধবিরতির আশায় আলোচনা, বাস্তবে বন্দিবিনিময়
সোমবার রাশিয়া ও ইউক্রেন ২৫ বছরের কম বয়সী যুদ্ধবন্দিদের আবেগঘন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য বিনিময় করেছে, যা পরিকল্পিত বন্দি বিনিময়ের একটি সিরিজের প্রথম পদক্ষেপ, যা এখন পর্যন্ত যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ঘটনা হতে পারে।
এই বিনিময়টি ছিল ২ জুন ইস্তাম্বুলে উভয় পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনার ফলাফল, যার ফলে উভয় পক্ষের কমপক্ষে এক হাজার ২০০ যুদ্ধবন্দি বিনিময় এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে নিহত হাজার হাজার যুদ্ধবন্দির মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার চুক্তিতে পৌঁছায়।
যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি শান্তি আলোচনা অব্যাহত থাকলেও তা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
তবে সোমবার দুই দেশ আবারও যুদ্ধবন্দি বিনিময় করেছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানান, বন্দি বিনিময়ের এই প্রক্রিয়ায় আহত সেনা ও ২৫ বছরের নিচে বয়সের ব্যক্তিরাও রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। প্রতিদিনই প্রায় নতুন করে আলোচনা করতে হয়’।
তবে কতজন বন্দি বিনিময় হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো পক্ষই নির্দিষ্ট সংখ্যা জানায়নি।
উত্তরের চেরনিহিভ অঞ্চলে বন্দিমুক্তির খবরে হাসপাতালের সামনে জড়ো হন বহু উদ্বিগ্ন স্বজন। ছবি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনরা আশায় ছিলেন, হয়তো তাদের প্রিয়জনদের কেউ ফিরে আসবেন।
চেরনিহিভের ৩৮ বছর বয়সী তেতিয়ানা লিতভিন জানান, তিনি তার বাবা ও চাচাতো ভাইয়ের খোঁজে এসেছেন—দুজনই গত বছর নিখোঁজ হন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ হয়তো একদিন শেষ হবে, কিন্তু যাদের স্বজন হারিয়ে গেছে, তাদের কাছে যুদ্ধ কখনোই শেষ হবে না।
’ তার চাচাতো ভাই, ২১ বছর বয়সী মাইকোলা দমিত্রুক নিখোঁজ হন যখন তার স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। তিনি আরো জানান, ‘তার এখন পাঁচ মাস বয়সী কন্যা সন্তান রয়েছে।
রাশিয়ার পাল্টা হামলা ও বিমানঘাঁটি লক্ষ্য
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনী রাশিয়ার নিঝনি নভগোরোদ অঞ্চলের সাভাসলেইকা বিমানঘাঁটিতে দুটি রুশ যুদ্ধবিমানে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে। যদিও এই হামলা কীভাবে চালানো হয়েছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। রুশ কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। কিছু রুশ যুদ্ধবিষয়ক ব্লগার অবশ্য দাবি করেছেন, যুদ্ধবিমানের ক্ষতি হয়নি।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইউক্রেনের ড্রোন হামলার প্রতিশোধ হিসেবে তারা পশ্চিম ইউক্রেনের রিভনে অঞ্চলের ডুবনো বিমানঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালিয়েছে।
মৃতদেহ হস্তান্তরেও জটিলতা
দুই দেশের মধ্যে নিহত সেনাদের দেহ হস্তান্তর নিয়েও মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। রাশিয়া অভিযোগ করেছে, ইউক্রেন তাদের নিহত সেনাদের লাশ গ্রহণে অনীহা দেখিয়েছে। অপরদিকে জেলেনস্কি অভিযোগ করেন, রাশিয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এক হাজার ইউক্রেনীয় নিহত সেনাদের নামের তালিকা কিয়েভে পাঠায়নি। তিনি রুশ কর্তৃপক্ষকে ‘নোংরা খেলা’ খেলছে বলেও অভিহিত করেন।
তবুও ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, লাশ বিনিময় কার্যক্রম এগিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যদিও এখনো কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়নি। ইউক্রেনের গোয়েন্দা প্রধান কিরিলো বুদানোভ জানান, চলতি সপ্তাহেই লাশ বিনিময় প্রক্রিয়া শুরু হবে।
রাশিয়ার দিকে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা অব্যাহত
গত ১ জুন ইউক্রেন রাশিয়ার দূরবর্তী বিমানঘাঁটিতে নজিরবিহীন ড্রোন হামলা চালায়, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জটিল ও ব্যাপক আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রবিবার রাতেই সাতটি রুশ অঞ্চলে ৪৯টি ইউক্রেনীয় ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। চুভাশিয়া অঞ্চলের একটি বৈদ্যুতিন যুদ্ধ উপকরণ উৎপাদন কেন্দ্রে দুটি ড্রোন আঘাত করেছে বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এই এলাকা মস্কোর প্রায় ৬০০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত।
বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির উদ্বেগ
জাতিসংঘ বলছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ১২ হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। যদিও রাশিয়া বরাবরই দাবি করে, তারা কেবলমাত্র সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে।
ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে বিশেষ করে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আরো সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে কিয়েভ কতটুকু সহায়তা পাবে, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
সরাসরি আলোচনায় অগ্রগতি নেই
সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত দুই দফা সরাসরি রুশ-ইউক্রেনীয় শান্তি আলোচনায় উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। আলোচনা মূলত বন্দি ও নিহতদের লাশ বিনিময়ের প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ থেকেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আগেই জানিয়েছেন, তার শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply