জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই দেশের এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচনের এই আয়োজনকে তৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন সাবেক নেতারা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পাননি। প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসে পেশিশক্তির জোরে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য দেখা গেছে। তারা গায়ের জোরে প্রতিনিধি সেজে ছাত্র সমাজকে কলঙ্কিত করেছে, ছাত্রদের মৌলিক স্বার্থকে ধ্বংস করেছে। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ এবং হল সংসদ নির্বাচন হলে এগুলো করার সুযোগ পেত না। তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কোনোভাবেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন তারা।
তাদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের সামনে ডাকসুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন কি ধরনের প্রভাব রাখবে, এইটা এই মুহূর্তে বোঝা মুশকিল। তবে যে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠন আছে, তাদের একটা পর্যবেক্ষণ থাকবে এ নির্বাচন ঘিরে। পাশাপাশি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে উপাদানগুলো যুক্ত হয়েছে, সেগুলো ডাকসুসহ ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে দিয়ে দেখা যাবে। কোনগুলো ছাত্ররা গ্রহণ করেন সেটাও বোঝা যাবে। আর ডাকসুসহ ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে জাতীয় নির্বাচনের আগে তা হবে একটা বড় বার্তা বলেও মনে করেন তারা।
জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম যুগান্তরকে বলেন, আমরা ছাত্র সংসদের নির্বাচনকে যদি জাতীয় রাজনীতির মোটিভ ফোর্স হিসাবে বিবেচনা করি, চালিকা শক্তি হিসাবে বিবেচনা করি তাহলে শ্রমিক-কৃষকসহ অন্যান্য মানুষের অধিকারটা কোথায় থাকবে? কৃত্রিম উপায়ে ছাত্রদের ওপরে একটা সাজানো-পাতানো নেতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়াটা খুবই অন্যায়। তবে একই সঙ্গে ডাকসুতে বিরাজনীতিকরণের প্রবণতা আগেও ছিল এখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দাবি করে তিনি আরও বলেন, এ ধরনের রাজনীতিকরণের একটা প্রবণতা আগেও ছিল। এখন আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। তবে আমি বলব, ‘ডি-পলিটিক্যালাইজেশন’ যেমন ক্ষতিকর একইভাবে মারাত্মক ক্ষতিকর হলো ‘ওভার পলিটিক্যালাইজেশন’।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, শুধু ডাকসু নয়, প্রত্যেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে উচ্চস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের নির্বাচিত সংসদ থাকা উচিত। এটা ছাত্র সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার। উকিল, প্রকৌশলী বা শ্রমিকের যদি সমিতি থাকে ছাত্রদের থাকবে না কেন? কেন ছাত্রদের বঞ্চিত করা হবে? ছাত্রদের দাবি-দাওয়া, অভিযোগ, প্রয়োজনীয়তা, আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার এবং সেটা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংসদের মাধ্যমে। এটা না হলে পেশিশক্তির অধিকারী বা হেলমেট বাহিনী গায়ের জোরে প্রতিনিধি সেজে ছাত্র সমাজকে কলঙ্কিত করে, ছাত্র সমাজের মৌলিক স্বার্থকে ধ্বংস করে। এছাড়া দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে উঠা এবং জাতীয় কর্তব্য পালনের প্রয়োজনেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং একাডেমিক ক্যালেন্ডারে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টাও থাকা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে যে গত বছরের ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের তথা আওয়ামী লীগের পলায়নের পর সামগ্রিকভাবে রাজনীতিতে একটা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শিডিউল না দিলেও বলা যেতে পারে জাতীয় নির্বাচন ঘোষিত হয়েছে। সেটার ওপরে নির্ভর করছে এই এত বিশাল অভ্যুত্থানের লক্ষ্য অর্জন বা বাস্তবায়নের সাফল্য। এই নির্বাচনের সামনে ডাকসুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন কি ধরনের প্রভাব রাখবে, এটা বোঝা মুশকিল। কারণ এই ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো ছাত্র রাজনীতি ছিল না। একদম একদলীয় প্রভাব ছিল। গেস্টরুম কালচার, র্যাগিং, বুলিং সবকিছু হয়েছে। কিন্তু রাজনীতি ছিল না।
তিনি আরও বলেন, এখন ডাকসু নির্বাচনের আর ১৫ দিনের মতো বাকি আছে। এই সময়েও কেউ বলতে পারছে না যে কি চরিত্রের, কি রূপে এই নির্বাচনটা হবে। আগে এরকম হতো যে ডাকসু নির্বাচনে যে ফলাফল হতো সেটা জাতীয় নির্বাচনে সরাসরি প্রভাব রাখত। কিন্তু এখন সেভাবে বলা যাচ্ছে না। কারণ এখানে কারা জিতবে তা বোঝা যাচ্ছে না। যারা জিতবে তারা এমনিতে জাতীয় রাজনীতিতে কোনো ম্যাটার কি তা বোঝা যাচ্ছে না। যারা জাতীয় রাজনীতির বিশেষভাবে ম্যাটার করে তারা কতখানি এখানে সংগঠিত সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।
এমনিতেই ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে একটা শঙ্কা ছিল ছিল যে এই নির্বাচনের ওপর কোনো সমস্যা তৈরি হলে, সেটা জাতীয় নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এখন বলা যায় যে নির্বাচনটা হচ্ছে। কতখানি সুষ্ঠু হবে, ভালো হবে এবং প্রশ্নাতীত হবে কিংবা এটা কতটা বিশ্বাস-আস্থা বা শঙ্কা-অনাস্থা তৈরি করবে সেটা তো এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে আমি আশা করব যে এটা ঠিকঠাক মতো হয়ে যাবে।
ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের মতো হবে। ছাত্র নির্বাচন তাদের মতো হবে। তবে এটা হয়তো একে অপরকে পর্যবেক্ষণ করবে। বিশেষ করে যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠন আছে। তিনি আরও বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে উপাদানগুলো যুক্ত হয়েছে, সেগুলো ডাকসুসহ ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে দিয়ে দেখা যাবে। কোনগুলো ছাত্ররা গ্রহণ করেন সেটাও বোঝা যাবে। এছাড়া সবচেয়ে বড় কথা ছাত্রদের ক্লাসরুমের বাইরে যে অনেক কাজ রয়েছে, যেমন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা সেগুলোও কিন্তু বহুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। সেগুলো ধারাবাহিকভাবে থাকলে ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক সচেতনতা, সাংগঠনিক দক্ষতা আরও ভালো হতো।
তিনি আরও বলেন, এখন নির্বাচন যদি খুবই সুন্দর পরিবেশ হয়, ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় সেটা, পার্লামেন্ট নির্বাচনে একটা ভালো উদাহরণ হবে। ছাত্ররা যদি একটা ভালো নির্বাচন করতে পারে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারে তাহলে জাতীয় নির্বাচন কেন শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না? সেটা একটা ইফেক্ট হতে পারে। আমার প্রত্যাশা থাকবে ছাত্ররা যেন স্বাধীনভাবে তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারে। অবাধে মতপ্রকাশ করতে পারে। কোনো রকম ভয়-ভীতির পরিবেশ থাকবে না বলেই আমরা আশা করি।
ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর যুগান্তরকে বলেন, এই নির্বাচন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে আমার কাছে সে রকম মনে হয় না। কারণ হচ্ছে যে দেখা যায় যে সাধারণত পলিটিক্যাল গভর্নমেন্টের সময় ডাকসুতে বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো ভালো করে। এখন তো কার্যত ওইভাবে রাজনৈতিক সরকার নেই। আর আমার মনে হয় না এখানে একক কোনো প্যানেল বিজয়ী হবে। বিভিন্ন প্যানেলের বিভিন্ন প্রার্থী যাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে তথা বিগত বছরগুলোতে ক্যাম্পাসে অ্যাকটিভিজম তথা আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা আছে। এ রকম শিক্ষার্থীরা বের হয়ে আসছে। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় একটা ভালো সমন্বয় হবে, ভালো নির্বাচন হবে এবং ভালো নেতৃত্ব বের হয়ে আসবে। তবে জাতীয় রাজনীতিতে খুব বেশি প্রভাব এই নির্বাচনে থাকবে বলে আমার মনে হয় না।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ সোহেল মিয়া সরকারি, সম্পাদক : শামীম, বার্তা সম্পাদক : ইসমত প্রধান উপদেষ্টা : মোঃ পিন্টু
ঠিকানা : ২২৪ / ১ ফকিরাপুল, মতিঝিল ঢাকা-১০০০ মোবাইল : ০১৭৬৫৮৯৪১৭১